
মোঃ সাইফুল ইসলাম সায়েম:
জাতীয় নির্বাচনের বাকী আর মাত্র আট মাস। দেশের অন্যান্য সকল আসনের মতো নারায়ণগঞ্জ-১ আসনেও এরই মাঝে নির্বাচনী তৎপরতা শুরু হয়েছে সম্ভাব্য মনোনয়ন প্রত্যাশী নেতৃবৃন্দের মাঝে। একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার চেষ্টার কারণে এবং ত্যাগী নেতাকর্মীদের অবমূল্যায়ন করায় এই আসনের পর পর ৩ বারের এমপি গোলাম দস্তগীর গাজী বীর প্রতিকের বিরুদ্ধে ফুসে উঠেছে স্থানীয় আওয়ামীলীগ নেতাকর্মীরা। ফলে এ আসনটিতে আওয়ামীলীগ থেকে অন্তত ৩০ জন নেতা নৌকার মনোনয়ন চাইতে পারে বলে জানা গেছে। বিপরীতে বিএনপি থেকেও অন্তত ৩ নেতা ধানের শীষের মনোনয়ন চাইবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। এছাড়া জাতীয় পার্টি থেকে ২জন চাইবেন দলীয় মনোনয়ন।
নির্বাচন কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, আর মাত্র আট মাস পর অর্থাৎ ২০২৪ সালের জানুয়ারী মাসেই অনুষ্ঠিত হবে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। আসন্ন নির্বাচনকে সামনে রেখে বরাবরের মতো এবারও রাজধানী ঢাকার সবচেয়ে নিকটবর্তী জেলা হিসাবে নারায়ণগঞ্জের আসনগুলোর প্রতি বিশেষ নজর রয়েছে প্রধান রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টির। নারায়ণগঞ্জের ৫টি আসনের মধ্যে রূপগঞ্জ আসনটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ। কেননা রাজধানী ঢাকার আদলে সর্বোচ্চ সুযোগ সুবিধা সমৃদ্ধ টাউনশীপ “পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্প”র অধিকাংশ এরিয়াই রূপগঞ্জ থানার তথা এই আসনের অন্তর্গত। পাশাপাশি দেশের প্রায় সকল শিল্প প্রতিষ্ঠানের শিল্প কারখানা এখানে অবস্থিত। তাই বাণিজ্যিক ও রাজনৈতিক কারণে দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আসন হচ্ছে নারায়ণগঞ্জ-১ আসনটি।
স্থানীয় সুত্রে জানা গেছে, গাজী গোলাম দস্তগীরের একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার চেষ্টার কারণে ও তার প্রতি অসন্তুষ্টির কারণে গত নির্বাচনে এই আসন থেকে তিনি ছাড়াও ৩০জন মনোনয়ন প্রত্যাশী আওয়ামীলীগের দলীয় মনোনয়ন কিনেছিলেন। যদিও গোলাম দস্তগীর গাজীকেই এই আসনে নৌকার মনোনয়ন দেয়া হয়েছিলে ২০১৮ নির্বাচনে। এর কারণ হিসাবে মনোনয়ন প্রত্যাশীদের অনেকেই তখন বলেছিলেন, টাকার কাছে তারা হেরে গিয়েছিলেন তারা। ক্ষোভ প্রকাশ করে তারা বলেছিলেন, দীর্ঘ সময় ধরে আওয়ামী সংগঠনের সাথে জড়িত থেকেও শিল্পপতিদের টাকার কাছে হেরে যায় পোড় খাওয়া নেতাকর্মীরা।
আসন্ন নির্বাচনে মনোনয়ন প্রত্যাশীদের বিষয়ে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এ আসন থেকে আওয়ামী লীগের ৩ বারের এমপি, বর্তমান পাট ও বস্ত্র মন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী, বীর প্রতীক এমপি এবারও দলীয় মনোনয়ন চাইবেন। তার বিপরীতের এবারও একই সংখ্যক প্রার্থী নারায়ণগঞ্জ-১ আসনে আওয়ামীলীগের দলীয় মনোনয়ন চাইতে পারেন বলে জানা গেছে।
সাবেক সংসদ সদস্য ও সাবেক সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল (অব.) কে এম সফিউল্লাহ (বীর উত্তম), জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আব্দুল হাই, রূপগঞ্জ উপজেলার কায়েতপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলাম রফিক, উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাবেক সভাপতি তোফাজ্জল হোসেন মোল্লা, সহ-সভাপতি আবুল বাশার শুক্কুর, সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক এনামুল হক ভূইয়া, সাবেক প্রচার সম্পাদক ও জেলা যুব ও ক্রীড়া সম্পাদক মানজারী আলম টুটুল, সাবেক দফতর সম্পাদক আব্দুল আজিজ, মুক্তিযুদ্ধকালীন থানা কমান্ডার আব্দুর জব্বার পিনু, ইঞ্জিনিয়ার শেখ সাইফুল ইসলাম, কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক সহ-সভাপতি হাফিজুর রহমান ভূইয়া সজিব, উপজেলা পরিষদের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান ও রূপগঞ্জ ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রহমান হারেজ, মুক্তিযুদ্ধকালীন রূপগঞ্জ থানা কমান্ডার আব্দুল জাব্বার খান পিনুসহ আরও অনেকেই এই আসনে মনোনয়ন প্রত্যাশী বলে জানা গেছে। তারা প্রত্যেকেই গত নির্বাচনেও আওয়ামীলীগের দলীয় মনোনয়ন সংগ্রহ করেছিলেন।
তৃণমূলের ত্যাগী নেতাকর্মীদের মতে, স্থানীয় আওয়ামীলীগকে ঐক্যবদ্ধ করার বিপরীতে টুকরো টুকরো করতে কাজ করেছেন তিনি। ত্যাগী নেতাকর্মীদের যথাযথ মূল্যায়ন না করে, এমপি ও মন্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও উপজেলা আওয়ামীলীগের সভাপতির পদটিও আকড়ে রেখেছেন তিনি, যা কখনোই কাম্য নয়। একইসাথে কখনো আওয়ামী রাজনীতির সাথে জড়িত না থাকার পরও হুট করেই নিজের স্ত্রী হাসিনা গাজী ও ছেলে পাপ্পা গাজীকে উপজেলা আওয়ামীলীগের সদস্য হিসাবে করেছেন। অথচ ত্যাগী ও পোড় খাওয়া, দু:সময়ের অনেক নেতাকর্মীকে না রাখার অভিযোগ রয়েছে এই কমিটির বিরুদ্ধে।
এছাড়া, তিনি নিজেও সংগঠন না করেই টাকার জোরে বারবার দলীয় মনোনয়ন পেয়ে যান বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন ত্যাগী নেতাকর্মীদের অনেকে। এ বিষয়ে কথা হলে রূপগঞ্জ উপজেলা আওয়ামীলীগের বার বার নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক ও উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শাহজাহান ভুইয়াও ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, উনি (গোলাম দস্তগীর গাজী) নিজেই তো সংগঠন না করে আওয়ামীলীগে এসেছেন, এমপি হয়েছেন। উনি কিভাবে ত্যাগী ও পোড় খাওয়া নেতাকর্মীদের দু:খ বুঝবেন ?
তিনি আরও বলেন, গত নির্বাচনে জনপ্রিয়তার শীর্ষে ছিলাম আমি, তারপরও মনোনয়ন বোর্ড আমাকে মনোনয়ন দেয়নি। আগামী নির্বাচনেও আমি এই আসনে নৌকার মনোনয়ন প্রত্যাশী। ‘ছাত্রজীবন থেকে এই দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত আছি। ১৯৯২ সাল থেকে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করে আসছি। তৃণমূলের সব নেতাকর্মী আমার নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ আছে। দল আমাকে এবার মূল্যায়ণ করবে বলে তিনি আশাবাদী। আগামী নির্বাচনে দল তাকে মনোনয়ন দিলে বিপুল ভোটের ব্যবধানে জয়লাভ করার আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি। ”
তাই এবার হয়তো ফাকা মাঠে গোল করার সেই সুযোগ নাও পেতে পারেন গাজী। কেননা বিএনপির চলমান আন্দোলন সংগ্রামে একটি বিষয় স্পষ্ট যে দলটি এবার নির্বাচনে যেতে চায়। ফলে বিএনপির দাবী মেনে নিয়ে সত্যি যদি নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হয় তাহলে আসনটিতে কঠিন লড়াইয়ের মুখোমুখি হতে হবে আওয়ামীলীগের প্রার্থীকে এমনটাই দাবী স্থানীয়দের।
তাই আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামীলীগ-বিএনপি দুই দলই এই আসনে জয় পেতে মরিয়া। কেননা ২০০১ সালের পর বিএনপি আর এই আসনে জয় পায় নি, তাই তারা পুনরায় যে কোন মুল্যে তাদের বিজয় ছিনিয়ে আনতে চাইবে। অপরদিকে পর পর তিনবার এই আসনে জয়লাভের পর আওয়ামীলীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার কোনভাবেই তাদের পরাজয় মেনে নিতে চাইবেনা। ফলে রূপগঞ্জের উন্নয়নে আগামী ২০২৪ সালের জাতীয় নির্বাচনে বড় দুই দলের নড়াচড়া শুরু হতেই জনগণ ও ভাবতে শুরু করেছে কে হবেন তাদের ভবিষ্যৎ জনপ্রতিনিধি।
তবে, দলীয় মনোনয়ন পাওয়ার ক্ষেত্রে তার পথে বাধা হতে পারে বসুন্ধরা গ্রুপের ব্যবসায়ীক বন্ধু, রংধনু গ্রুপের চেয়ারম্যান, কায়েতপাড়া ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলাম ওরফে আন্ডা রফিক। কেননা স্থানীয় রাজনীতিতে নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের সংসদ সদস্য শামীম ওসমানের অনুসারী এই রফিক।
বিপরীতে বিএনপিতেও মনোনয়ন দৌড়ে ৩জন প্রার্থী রয়েছেন আলোচনায়। এদের একজন জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি ও বহিস্কৃত বিএনপি নেতা এড. তৈমুর আলম খন্দকার, জেলা বিএনপির আরেক সাবেক সভাপতি কাজী মনিরুজ্জামান মনির এবং অপরজন হলেন বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য মোস্তাফিজুর রহমান ভূঁইয়া দিপু। বিএনপির রাজনীতিতে সিনিয়র হিসাবে সাবেক সভাপতি কাজী মনির মনোনয়ণ দৌড়ে কিছুটা এগিয়ে থাকবেন বলে মনে করে তৃনমুল বিএনপির নেতাকর্মী, স্থানীয় জনগন ও রাজণৈতিক বিশ্লেষক মহল।
অপরদিকে, পাকিস্তান সরকার ঘোষিত ২২ পরিবারের অন্যতম ভুঁইয়া পরিবারের সন্তান সাবেক সিআইপি গোলবক্স ভুঁইয়ার নাতি, জাতীয় পার্টির সাবেক এমপি সুলতান উদ্দিন ভুঁইয়ার ভাতিজা ও রূপগঞ্জ উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান ভুঁইয়ার ছেলে মোস্তাফিজুর রহমান ভুঁইয়া দিপু ক্লিন রাজনীতিতে রূপগঞ্জে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছেন। বিএনপির রাজনীতিতে দিন দিন দিপুর অবস্থান শক্ত হচ্ছে। তাই তার সমর্থকরা মনে করেন ক্লিন ইমেজের দিপু ভুইয়া যদি এই আসনে মনোনয়ণ লাভ করেন তাহলে বিএনপির জয়ের সম্ভাবনা থাকবে সবচেয়ে বেশী।
তবে দুই দলই চাইছে পরিচ্ছন্ন, গোছানো ও ক্লিন ইমেজের জনপ্রিয় ব্যক্তিকে মনোনয়ন দিতে। কেননা অনির্বাচিত সরকারের যে তকমা ঝুলছে আওয়ামীলীগের বিরুদ্ধে সেই তকমা ঘুচিয়ে আওয়ামীলীগের সভানেত্রী ও বর্তমান প্রধামন্ত্রী শেখ হাসিনা সকল দলের অংশগ্রহনে একটি সুষ্ঠ নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় যেতে চাচ্ছে। অপরদিক নির্দলীয় তত্ত্বাধায়ক সরকারের অধীনে আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহনের মাধ্যমে ক্ষমতায় যেতে মরিয়া হয়ে রয়েছে বিএনপি।
জানা গেছে, ১৯৯১ সালের নির্বাচনে নারায়ণগঞ্জ-১ আসনে জয়লাভ করে বিএনপির প্রার্থী। তবে ’৯৬ সালে এই আসনে বিজয় ছিনিয়ে নেয় আওয়ামীলীগ। ২০০১ সালের নির্বাচনে আবারও বিজয় পুনরুদ্ধার করে বিএনপি। তবে ২০০৮, ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনে পরপর তিনবার জয় পায় আওয়ামীলীগের প্রার্থী গোলাম দস্তগীর গাজী। যদিও ১৪’ ও ১৮’ সালের নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেয়নি। তাই অনেকটা ফাকা মাঠেই গোল করেন তিনি।