
নারায়ণগঞ্জ সমাচার:
সারাদেশের ন্যায় নারায়ণগঞ্জেও দিন দিন বাড়ছে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। এডিসবাহিত এ মশার অত্যাচারে অতিষ্ঠ নারায়ণগঞ্জবাসীকে বাঁচাতে কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেই সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভা, উপজেলা, ও ইউনিয়ন পরিষদগুলোর। ফলে, জেলার সর্বত্রই এখন দিন-রাত ২৪ ঘন্টা এখন মশার উপদ্রব, যা কোনোভাবেই কমানো যাচ্ছে না। দীর্ঘদিন ধরে নেই স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর মশক নিধন কর্মসূচি কিংবা স্বাস্থ্য বিভাগের মশক জরিপ কার্যক্রম। এমন অবস্থায় কর্তৃপক্ষের নির্লিপ্ততা ভোগান্তি বাড়াচ্ছে, ফলে মশার উৎপাতে অতিষ্ঠ নারায়ণগঞ্জবাসী এখন ডেঙ্গু আতঙ্কে ভুগছেন।
সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, নারায়ণগঞ্জ ৩০০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতালে ৭ জন, নারায়ণগঞ্জ ১০০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতালে ২জন শিশু, উপজেলা, বেসরকারী হাসপাতাল ও প্রাইভেট ক্লিনিকগুলোতে ২/৩ জন করে রোগী ভর্তি আছেন বলে জানা গেছে। সর্বমোট প্রায় ৪ শতাধিক ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী সরকারী হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা নিয়ে বাড়ি ফিরেছেন বলে জানিয়েছেন জেলা স্বাস্থ্য বিভাগ। এছাড়া, সুনির্দিষ্ট সংখ্যা উল্লেখ করতে না পারলেও অনেকে প্রাইভেট ক্লিনিক ও বেসরকারী হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা নিয়েছেন বলেও জানা তারা। তবে, নারায়ণগঞ্জে এখনও ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে কেউ মারা যাননি বলেও জানায় স্বাস্থ্য বিভাগ।
জানা গেছে, বিভিন্ন সময়ে নারায়ণগঞ্জবাসী যানজট, জলাবদ্ধতা, গ্যাস কিংবা পানির সংকটের মতো নানা সমস্যার মুখে পড়েছে। তবে সব কিছুকে ছাপিয়ে আলোচনায় এখন মশার উপদ্রব আর ডেঙ্গু আতঙ্ক। দলবল নিয়ে রক্তের সন্ধানে সারাক্ষণই চলছে তাদের ছোটাছুটি। এতে ডেঙ্গুর ভয়ে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে মানুষ। ক্ষুদ্র মশার উৎপাতে রীতিমতো অসহায় বসবাসকারীরা। কয়েল জ্বালিয়ে কিংবা অ্যারোসল দিয়েও রেহাই পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে দিনের বেলায়ও মশারি টানাতে হচ্ছে অনেককে।
সাধারণ মানুষের মতে, ডেঙ্গু নতুন কোনো রোগ নয়। এটা প্রতিকারের জন্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর যে উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন ছিল, তাতে তারা সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। মশার ওষুধ ছিটানো, জনগণকে এডিস মশা বিষয়ে সচেতন করার জন্য বেশি টাকার প্রয়োজন হয় না। প্রতিবছরই করের বোঝা চাপানো হচ্ছে জনগনের কাধে, কিন্তু মশা মারার নাম নেই। অবিলম্বে এডিস মশার কবল থেকে নারায়ণগঞ্জবাসীকে রক্ষার জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানান তাঁরা।
দেওভোগ পাক্কারোডের বাসিন্দা সাথী ইসলাম বলেন, আমরা দিন-রাত ডেঙ্গু আতঙ্কে থাকি। আশপাশের সবার কাছ থেকে শুনছি, অনেকের ডেঙ্গু হচ্ছে। আমার বাড়িতেও ছোট বাচ্চা আছে। সে কারণে ভয়টা আরও বেশি। দিন-রাত সব সময় মশারি টানিয়ে রাখতে হচ্ছে। বাড়িতে পানি জমতে দিচ্ছি না কিন্তু বাইরে থেকে মশা এসে কামড়ালে এর দায় কে নেবে? সিটি কর্পোরেশন কী করে বুঝি না। আমরা তো নিয়মিত সিটি কর্পোরেশনের কর পরিশোধ করি, তাহলে তাদের কাছ থেকে সেবা কেন পাব না?
ফতুল্লা ইউনিয়নের বাড়ির মালিক রাইসুল ইসলাম বলেন, আমার এক আত্মীয়র ডেঙ্গু হয়েছে। বাসা, দোকান, বাইরে– সবখানে মশার উপদ্রব। কোনোভাবেই মশা কমে না। ইউনিয়ন পরিষদের কাউকেও নিয়মিত মশার ওষুধ ছেটাতে দেখা যায় না। চারদিকে শুধু ডেঙ্গু রোগীর খবর শোনা যাচ্ছে। এখন যদি ইউনিয়ন পরিষদ থেকে ব্যবস্থা সেভাবে না নেওয়া হয়, তাহলে তো আমরা কেউই নিরাপদ নয়। আমরা চাই, ইউনিয়ন পরিষদ মশা মারতে জোরালো উদ্যোগ নিক এবং আমাদের ডেঙ্গু আক্রান্ত হওয়া থেকে রক্ষা করুক।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাড়ির আশপাশের ঝোপঝাড় ও পানি জমার জায়গা পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। বাড়ির ভেতর বা বাইরে কোথাও পানি জমতে দেওয়া যাবে না। এডিস মশা যেহেতু দিনে বেশি কামড়ায়, তাই দিনের বেলা ঘুমালে মশারি টাঙিয়ে ঘুমাতে হবে। ঘরের চারদিকের জানালায় নেট লাগাতে হবে। স্কুলপড়ুয়া শিশুদের হাফপ্যান্ট না পরিয়ে ফুল প্যান্ট বা পায়জামা পরিয়ে স্কুলে পাঠাতে হবে। ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীকে সব সময় মশারির ভেতর রাখতে হবে। মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গু থেকে বাঁচতে সচেতনতার বিকল্প নেই। কেননা, এর কোনো ভ্যাকসিন নেই, সুনির্দিষ্টভাবে কার্যকর ওষুধও নেই। তাই ডেঙ্গুর প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধে সচেতন হওয়া বেশি জরুরি বলে মনে করেন গবেষকেরা।
আইইডিসিআর’র সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মুশতাক হোসেন গণমাধ্যমে বলেন, মনে রাখতে হবে, ডেঙ্গু হলে রক্তে প্লাটিলেটের পরিমাণ কমতে থাকে। তাই রোগীর প্রতি সামান্য অবহেলা বড় ধরনের ঝুঁকি ডেকে আনতে পারে। ডেঙ্গু প্রতিরোধে জরুরি ভিত্তিতে উদ্যোগ নিতে হবে। এটা হতে হবে সমন্বিত। অস্থায়ী উদ্যোগ নিয়ে এ সমস্যার ভালো সমাধান আশা করা যায় না। যাতে ডেঙ্গু জ্বরের বাহক এডিস মশা বংশবিস্তার করতে না পারে সে জন্য পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা অভিযান জোরদার করতে হবে। এখানে শুধু সিটি করপোরেশন বা অন্য কোনো স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের দিকে তাকিয়ে থাকলে চলবে না; নিজ উদ্যোগে বাসাবাড়ির ছাদ ও আঙিনা পরিস্কার রাখতে হবে। পাকা রাস্তার পাশের গর্তেও এ মশা জন্মাচ্ছে।
গতকাল রবিবার স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছেন, “দেশের ৬৭টি জেলায় ডেঙ্গু ছড়িয়ে গেছে। এখন পর্যন্ত প্রায় ১২ হাজার রোগী ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন, যাদের মধ্যে বিভিন্ন হাসপাতালে প্রায় আড়াই হাজার মানুষ এখনো চিকিৎসাধীন। আর চিকিৎসা নিয়ে বাড়ি চলে গেছে ৯ হাজারের বেশি লোক। দেশে আগস্ট এবং সেপ্টেম্বর মাসে ডেঙ্গু আরও বাড়তে পারে। সেজন্য এখন থেকেই সবাইকে সজাগ এবং সচেতন হতে হবে।” দেশের সকল সিটি কর্পোরেশন এবং পৌরসভাগুলোর উদ্দেশে স্বাস্থ্যমন্ত্রী এদিন বলেন, “সিটি কর্পোরেশন এবং পৌরসভাগুলোর প্রতি আহ্বান থাকবে, তারা যেন বেশি বেশি স্প্রে করে এবং যেখানে যেখানে পানি জমে আছে সেগুলো সরিয়ে ফেলে। যেখানে বহুতল ভবন আছে সেখানে ডেঙ্গু বেশি দেখা দিচ্ছে। কারণ সেসব ভবনের নিচে গ্যারেজ আছে এবং পানি জমে থাকে। নির্মাণাধীন ভবনগুলোতে বেশি পানি জমে থাকায় সেখানে এডিস মশা জন্ম নেয়।”
নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের দাবি, মশা নিয়ন্ত্রণে পরিকল্পনা আছে তাদের। শীঘ্রই বাস্তবায়ন করা হবে সকল পরিকল্পনার। তবে, কবে নাগাদ কার্যক্রম শুরু হতে পারে নির্দিষ্ট করে তা বলতে পারেনি তারা। এ বিষয়ে নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের সিইও শহীদুল ইসলাম শীতলক্ষাকে বলেন, আমাদের মশার ওষুধ ছিটানোর কার্যক্রম চলতেছে। পাশাপাশি এডিস মশার প্রজননস্থল অনুসন্ধানে অভিযান শীঘ্রই শুরু হবে এবং মানুষকে সচেতন করার বিষয়ে সচেতনতা কার্যক্রমের বিষয়ে আমাদের কর্মপরিকল্পনা নেয়া হয়েছে।
ফতুল্লা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান খন্দকার লুৎফর রহমান স্বপন বলেন, ডেঙ্গু প্রতিরোধ করার মতো ক্ষমতা আমাদের নাই। মশার ওষুধ আছে, ওগুলো ছিটাবো। বৃষ্টির কারণে এখনতো জায়গায় জায়গায় পানি, তাই যাওয়া যাচ্ছে না। পানি কমলে আশা করছি, আগামী সপ্তাহ থেকে হয়তো ওষুধ ছিটানো আরম্ভ করবো। তিনি আরও বলেন, সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে আমরা মাইকিং করেছি, লিফলেট বিতরণ করেছি কিন্তু মানুষ আসলে শুনে না। এডিস মশার লার্ভা অনুসন্ধানে কোনো অভিযানের মাধ্যমে জরিমানা কার্যক্রম চালাবেন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, জরিমানা তো দুরের কথা, আমাদের ট্যাক্সই তো দিচ্ছে না, পারলে আমাদের আরও মারে। ইউনিয়ন পরিষদের তো জনবল নাই। আমাদের ম্যাজিষ্ট্রেট নেই। মেম্বাররা কেউ এই দায়িত্ব নিতে চায় না। ম্যাজিষ্ট্রেসি পাওয়ারটা যদি থাকতো তাহলে আমরা অভিযান দিয়ে জরিমানা করতে পারতাম। তবে, জনসাধারণকে আরও বেশী সচেতন হওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।
জেলা সিভিল সার্জন ডা. আবুল ফজল মোহাম্মদ মশিউর রহমান বলেন, আমাদের ডেঙ্গু অবস্থা আলহামদুলিল্লাহ ভালো, আমাদের কোনো মৃত্যু নাই। প্রতিদিন ৪/৫টা করে রোগী ভর্তি হয় এবং বহির্বিভাগে ১৫/২০ জন রোগী সেবা নেয়। ঢাকার কাছাকাছি হওয়াতে বাইরে অনেক বেসরকারী প্রতিষ্ঠান আছে, যেখানে অনেকে চিকিৎসা নেয়। হাসপাতালে তেমন একটা চাপ নেই। ঢাকার পাশ্ববর্তী জেলা হওয়ার পরও এখানে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা কম বলেও জানান জেলা স্বাস্থ্য বিভাগের এ প্রধান কর্মকর্তা।
তিনি আরও বলেন, মশার প্রতিরোধের কাজটা করে সিটি কর্পোরেশন, উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদগুলো। আমরা তো চিকিৎসার বিষয়টা দেখি। এখানে মশা তো প্রচন্ড। বিশেষ করে ফতুল্লা ইউনিয়ন পরিষদের আওতাভুক্ত এলাকায় আমাদের যে বাসাগুলো, সিভিল সার্জনের বাসা, জজ সাহেবের কোয়ার্টার, ডিসি অফিস সংলগ্ন এলাকায় মশার উপদ্রব অনেক বেশী। ভবিষ্যতে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে জানিয়ে, এখনই সকলকে আরও বেশী সচেতন হওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।