চিন্তিত স্বল্প আয়ের মানুষ, বিদায় জানাচ্ছেন বাণিজ্যের নগরী নারায়ণগঞ্জকে

42
কঠোর লকডাউনের খবরে নারায়ণগঞ্জ ছাড়ছে মানুষ। শহরের চাষাড়া আর্মি মার্কেটস্থ রংপুরগামী কাউন্টার থেকে ছবিটি তুলেছেন চিত্রশিল্পী রিপন মাহমুদ

নারায়ণগঞ্জ সমাচার, মো. সাইফুল ইসলাম সায়েম:

ক্ষমতাধর সকল রাষ্ট্রসহ পুরো বিশ^কে নাস্তানাবুদ করা কোভিড-১৯ এর সংক্রমণের মাত্রা বর্তমানে আগের চেয়েও বেশী। তাই সংক্রমণের এ গতির লাগাম টেনে ধরতে সরকার ঘোষিত ১৪ এপ্রিল থেকে চালু হওয়া কঠোর লকডাউনকে স্বাগত জানিয়েছে নারায়ণগঞ্জবাসী। তবে গত বছরের লকডাউনের ক্ষত সারিয়ে উঠতে না পারা নারায়ণগঞ্জে বসবাসকারী স্বল্প আয় ও দিন আনে দিন খায় এমন শ্রেণীর মানুষেরা করোনায় আক্রান্ত হওয়ার চেয়ে খেয়ে-পরে বেঁচে থাকা নিয়ে বেশী চিন্তিত। অনেকে আবার এ চিন্তা থেকে নারায়ণগঞ্জ ছেড়ে নিজ নিজ গ্রামের বাড়িতে ছুটছেন।

গত বছরের লকডাউনের সময় রাইফেল ক্লাবের সামনে কোনো একদিন টহলরত অবস্থায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর গাড়ির সামনে রাস্তা আটকে রাখে নিম্ন আয়ের মানুষজন। সেই স্মৃতি শহরের মানুষের মনে আছে এখনো। চাকরী হারিয়েছে হাজার হাজার মানুষ, ব্যবসাও গুটিয়ে নিয়েছিলেন অনেকে। এছাড়া, রাস্তায় রাস্তায় ক্ষুধার্ত মানুষের দীর্ঘ সারি, কোথাও ত্রাণের সন্ধান পেলে ট্রাক বা ত্রাণের পিছনে ছুটে চলা এসবই মনে রেখেছে শহরবাসী।

তবে, সরকারের সাথে সাথে রাজনৈতিক ও সামাজিক বিভিন্ন সংগঠন, ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠান নানাভাবে সহযোগীতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলো সেই কথাও মনে আছে সকলের। যদিও সেই চেষ্টা ছিলো অপ্রতুল। কেননা শহরের অনেক ধনাঢ্য ও শিল্পপতিরা তখনও নিজেদের আখের গুছানোর চিন্তায় মানুষের সাহায্যার্থে এগিয়ে আসেন নি।
সেই ধকল কাটানোর প্রস্তুতিকালে আবারও মরণঘাতি করোনার উর্ধ্বগতিতে রুখে দিতে সরকার ঘোষিত এ লকডাউন সময়োপযোগী হলেও নারায়ণগঞ্জবাসী চিন্তিত হয়ে পড়েছে নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন স্তরের মানুষ। আসন্ন রজমানকে সামনে রেখে ইতিমধ্যেই বেড়েছে নিত্যপণ্যের দাম। লকডাউনের এ সময়ে কর্মহীন, চাকরীচ্যুত হওয়ার আশঙ্কা, বিভিন্ন ব্যাংক-এনজিও থেকে ঋন নিয়ে বিনিয়োগকারী ব্যবসায়ীসহ দিনমজুর ও খেটে খাওয়া মানুষগুলো সামনে দিনগুলো কিভাবে পার করবে এমন চিন্তায় মগ্ন হয়ে পড়েছে।

চাষাড়ায় চানমারী রেললাইনের বিপরীতে আর্মি মার্কেটে রয়েছে বেশ কয়েকটি আন্ত:জেলা পরিবহন কাউন্টার। এসব কাউন্টারে গিয়ে দেখা যায়, নিজ নিজ গ্রামের বাড়িতে ছুটছে মানুষ। নিজেরা ৩০/৪০ জন মিলে একত্রে বাস ভাড়া করে বুক ভরা বেদনা নিয়ে, ছাড়ছে নানা স্বপ্ন নিয়ে পাড়ি জমানো এ নারায়ণগঞ্জকে।

এসময় কথা হয় রংপুরের গঙ্গাচড়াগামী শাহীন মিয়ার সাথে। জানালেন নিজের কষ্টের গল্প। বললেন, লকডাউনে মার্কেট, গণপরিবহন সব কিছু বন্ধ ঘোষণায় চলে যাচ্ছি গ্রামের বাড়িতে। লকডাউনে কর্মহীন হয়ে পড়লে বাড়িতেও যাওয়া যাবে না এ ভাবনা থেকে আগেই চলে যাচ্ছেন। যাওয়ার সময় বললেন, চলে যাচ্ছি, এই শহর আর আমার হলো না। এমন আরো অনেকেই এখানে আছেন যারা বিদায় জানাবেন নারায়ণগঞ্জকে।

এদিকে, কঠোর এ লকডাউনের খবরে দিগু বাবুর বাজারসহ অন্যান্য বাজারগুলোতে বেচাকেনার ধুম পড়েছে। অনেকে ব্যাগ নিয়ে বাজারে ছুটতে শুরু করে। কথা হয় বাজার করতে আসা আসলাম মিয়ার সাথে। তিনি বলেন, কঠোর লকডাউনের কারণে দাম বাড়তে পারে এমন শঙ্কা থেকে বাজারে আসলেও যে অর্থ আছে তা দিয়ে ৪/৫ দিনের বাজার করা যাবে। এর পরের দিনগুলো নিয়ে চিন্তিত তিনি।

কথা হয় দেওভোগের পাইকারী পোশাক প্রস্তুতকারী মার্কেটের এক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর সাথে। করোনা প্রতিরোধে সরকারের লকডাউন দেয়ার সিদ্ধান্ত সঠিক মনে করলেও সামনে তাদের মহাবিপদ উল্লেখ করেন এ ব্যবসায়ী। তিনি বলেন, ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়া সহ বিভিন্ন জনের কাছ থেকে চড়া সুদে ঋণ নিয়ে গত বছরের লস কাটিয়ে উঠতে আসন্ন ঈদকে সামনে রেখে প্রায় ২০ লক্ষাধিক টাকার পোশাক প্রস্তত ও মজুদ করেছেন। যদি লকডাউন চলতে থাকে তাহলে বাহির থেকে পাইকাররা তথা পাইকারী ক্রেতারা আসতে না পারলে পথে বসতে হবে তার মতো অনেককে বলেন তিনি।

সাজু মিয়া, বয়স চল্লিশের মতো। ০৮-১০ বছর ধরে শহরের বিভিন্ন শো রুম, দোকানে সেলসম্যানের কাজ করছেন। দুই ছেলে মেয়ে, স্ত্রী ও বৃদ্ধ মাকে নিয়ে একরকম চলছিলো সংসার। করোনার আবারো উর্ধ্বগতিতে সামনের নিদগুলোতে ভয়াবহ পরিস্থিতির আচ করতে পারছেন তিনি। বললেন, মাসে ১৫ হাজার টাকা বেতন পাই। তা দিয়ে কোনোরকমে দিন চলে। গতবার ধারদেনা করে চললেও সামনের লকডাউনেও যদি মার্কেট বন্ধ থাকে তাহলে এবার না পরিবারের সদস্যদের নিয়ে না খেয়ে খাকতে হবে।

শুধু সাজু মিয়াই নয়, করোনায় বেকায়দায় পড়বেন নারায়ণগঞ্জের স্বল্প আয়ের মানুষগুলো। তার মতো বিপাকে পড়তে পারে হোটেল-রেস্তোরার শ্রমিক, দোকান কর্মচারী, গণপরিবহন শ্রমিক, দর্জি শ্রমিক, গৃহকমী, হকার সহ নিম্ন আয়ের সাধারন মানুষ। বিপাকে পড়বেন শুধুমাত্র বাড়ি ভাড়ার উপর নির্ভরশীল বাড়িওয়ালা, বাড়িতে বাড়িতে টিউশনি করে চলা গৃহশিক্ষক, ক্ষুদ্র দোকানদাররাও।

একই সাথে গতবার সরকারের সাথে সাথে বিভিন্ন ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠান যেভাবে এগিয়ে এসেছিলো এবারও সেইভাবে এগিয়ে আসবে এমন প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে জনমনে।