কোন্দল-বিভক্তিই প্রধান দুই দলের অর্জন

112
শামীম ওসমান, মেয়র আইভী, এমপি বাবু, আবদুল হাই, আনোয়াের হোসেন, ভিপি বাদল, খোকন সাহা, এড: তৈমুর, মামুন মাহমুদ, আবুল কালাম, গিয়াসউদ্দিন, কাজী মনির, এটিএম কামাল, এড: সাখাওয়াত হোসেন খান

নারায়ণগঞ্জ সমাচার:

দেশের অন্যান্য জেলার তুলনায় কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে নারায়ণগঞ্জের রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের কদর বেশী একথা জানা সবারই। এ কারণে কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দরাও স্থানীয় নেতাদের দেখেন আলাদা চোখে এমনটাই মনে করে রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহল। তাদের মতে, রাজনীতির সুতিকাগার হিসাবে পরিচিত এ নারায়ণগঞ্জে একসময় ঐক্যের রাজনীতি চললেও বর্তমানে চলছে বিভক্তি ও কোন্দলের রাজনীতি। বর্তমানে নারায়ণগঞ্জ আওয়ামীলীগ এবং বিএনপি কয়েক ভাগে বিভক্ত বলেও মনে করেন তারা।

আওয়ামীলীগ সুত্রে জানা যায়, নারায়ণগঞ্জ আওয়ামীলীগের রাজনীতিতে প্রভাবশালী দুই পরিবারের উত্তরসূরীরাই বারবার নেতৃত্ব দিয়ে আসছে। নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের সংসদ সদস্য একেএম শামীম ওসমান ও নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভীকে ঘিরেই চলছে নারায়ণগঞ্জ আওয়ামীলীগের কার্যক্রম। পাশাপাশি তাঁদের নিজ নিজ বলয়ের নেতাকর্মীরা দখল করে আছে সংগঠনের গুরুত্বপূর্ণ পদ-পদবী। ক্ষমতাসীন দলটি পরিবারকেন্দ্রিক হয়ে পড়ায় এবং এমপি ও মেয়রের মধ্যে বিরোধ ঘিরে সংগঠনের নিবেদিত প্রাণ নেতাকর্মীদের মধ্যে ক্ষোভ-হতাশা বিরাজ করছে।

তবে নারায়ণগঞ্জ আওয়ামীলীগের রাজনীতিকে এ দুই পরিবারের বন্দিদশা থেকে মুক্ত করতে চায় পরিচ্ছন্ন ও ত্যাগী নেতাকর্মীরা। তাদের মতে, দুই পরিবারের কাঁদা ছোড়াছুড়িতে দল, কর্মী ও সাধারণ জনগন সকলেই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বারবার। তাই এ বন্দিদশা থেকে মুক্ত করতে পরিচ্ছন্ন একজন নেতার মাধ্যমে নারায়ণগঞ্জ আওয়ামীলীগ পরিচালিত হোক এমনটাই প্রত্যাশা তাদের। ত্যাগী এ নেতাকর্মীরা মনে করে, বর্ষিয়ান রাজনীতিবীদ আনোয়ার হোসেন একজন পরিচ্ছন্ন ইমেজের অধিকারী। এ দুই বলয়ের বন্দিদশা থেকে দলকে মুক্ত করতে হলে তাকে নিয়েই সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে বলেও মনে করেন তারা।

অপরদিকে, বিএনপি সুত্রে জানা যায়, অন্তঃকোন্দল আর অসংখ্য ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে নারায়ণগঞ্জ বিএনপি। জেলা কমিটি ভেঙ্গে দেয়ার পর নতুন আহবায়ক কমিটি গঠনের পর থেকে ত্যাগী নেতাকর্মীদের মূল্যায়ন না করায় তাদের মাঝে দ্বন্দ্ব-বিভেদ ও হতাশার সৃষ্টি হয়েছে বলে জানা গেছে। এছাড়া মহানগর বিএনপির কমিটি গঠনের পর থেকেই নেতারা দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েন।

আ.লীগের প্রবীণ রাজনীতিবীদদের মতে, নারায়ণগঞ্জের আওয়ামী রাজনীতিতে ওসমান পরিবার ও চুনকা পরিবারের দ্বন্দ বেশ পুরোনো। ১৯৭২ সালে শহর আওয়ামীলীগের কাউন্সিল নিয়ে শামীম ওসমানের বাবা একেএম শামসুজ্জোহা ও আইভীর বাবা চুনকার মধ্যবর্তী দ্বন্দ প্রথম প্রকাশ্যে আসে। ৭৩’ এর পৌরসভা নির্বাচন নিয়ে দুই পরিবারের মাঝে আবারও দ্বন্দ দেখা দিলে এ দ্বন্দ আর দূর হয়নি কখনো। নানা ইস্যুতে এ দুই পরিবারের দ্বন্দ নারায়ণগঞ্জে আওয়ামীলীগের রাজনীতিকেও বারবার প্রভাবিত করছে। বর্তমানেও চলমান এ দুই পরিবারের দ্বন্দের একদিকে রয়েছেন মেয়র ডা. আইভী ও সাংসদ শামীম ওসমান। দুইজন বারবার পরস্পরবিরোধী বক্তব্য দিয়ে আলোচিত-সমালোচিত হয়েছেন।

এ দুইজনকে ঘিরেই চলছে নারায়ণগঞ্জ আওয়ামীলীগের রাজনীতি এমনটাই মনে করেন নেতাকর্মীরা। যার প্রমাণও পাওয়া যায় আওয়ামীলীগ ও সহযোগী সংগঠনের সর্বশেষ কমিটিগুলোর দিকে তাকালে। ২০১৫ সালে মহানগর আওয়ামীলীগের কমিটি গঠন করা হয় যাতে ১ নম্বর সদস্য হিসাবে রাখা হয় শামীম ওসমানকে, এছাড়াও এ কমিটিতে শামীম ওসমান অনুসারী নেতাকর্মীদের আধিক্যও দেখা যায়। এরপর ২০১৭ জেলা আওয়ামীলীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে আধিক্য ছিলো মেয়র ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী অনুসারীদের, যেখানে খোদ আইভীকেও সিনিয়র সহ-সভাপতির পদে আসীন করা হয়। এর পর জেলা আওয়ামীলীগের অধীনে ৫টি উপজেলার কমিটি গঠনের সময়েও এ দুই পরিবারের অনুসারীদের মাঝে অন্তর্দ্বন্দের সৃষ্টি হয় যা পরবর্তীতে জেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি হাই -সাধারণ সম্পাদক বাদল বনাম সিনিয়র সহ-সভাপতি আইভীর বলয়ে ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়ে। হাই-বাদলও মূলত শামীম ওসমান অনুসারী নেতাকর্মী হিসাবেই সর্বমহলে পরিচিত বলে জানায় তৃণমূল নেতাকর্মীরা।

ফলে এ দুই পরিবারের বাইরে গিয়ে আওয়ামী রাজনীতি করতে পারছেন না দলের অনেক ত্যাগী নেতাকর্মীরা। অনেকটা বাধ্য হয়েই এ দুই পরিবারের কোনো না কোনো বলয়ের সাথে মিশে রাজনীতি করতে হচ্ছে ত্যাগী অনেক নেতাকর্মীদের। অনেকে আবার কোনো বলয়ের রাজনীতি করতে চান না, তাই অনেকটা আড়ালে চলে যাচ্ছেন রাজনীতি থেকে।

এদিকে জেলা বিএনপির আহবায়ক কমিটিতে অনেক ত্যাগী নেতাদের মূল্যায়ন করা হয়নি বলে প্রশ্ন তুলেছে তাদের কর্মী সমর্থকরা। দলটিতে এ নিয়ে শুরু হয়েছে অন্তঃকোন্দল। এ আহবায়ক কমিটিকে একটি পক্ষ মেনে নিতে পারে নি বলেও জানা যায়। বিগত কমিটির বেলায়ও একটি পক্ষটি বরাবরই আলাদাভাবে দলীয় কার্যক্রম পালন করতো। তারই ধারাবাহিকতায় বর্তমান আহবায়ক কমিটি গঠনের পরেও দলের ত্যাগী নেতা হিসাবে পরিচিত মাসুকুল ইসলাম রাজীবসহ বেশ কয়েকজনকে আলাদাভাবে দলীয় আন্দোলন কর্মসূচী পালন করতে দেখা গেছে। ত্যাগী এসব নেতার কর্মী-সমর্থকদের দাবী, তৃণমূল নেতাকর্মীদের মতামত না নিয়েই এ আহবায়ক কমিটি গঠন করা হয়েছে। এতে জেলা বিএনপির একটি বড় অংশই ক্ষুব্ধ, হতাশ। তাই নতুন করে আবার কোন্দলের শুরু হয়েছে জেলা কমিটির পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদ-প্রত্যাশীদের মাঝে।

জেলা বিএনপিতে এড. তৈমুর আলম খন্দকার, কাজী মনিরুজ্জামান মনির, অধ্যাপক মামনু মাহমুদ, আতাউর রহমান আঙ্গুর, আজহারুল ইসলাম মান্নান, মোস্তাফিজুর রহমান দিপু ভুইয়া, নজরুল ইসলাম আজাদ অনুসারী নেতাকর্মীরা বেশ কয়েকটি ভাগে বিভক্ত।

অপরদিকে মহানগর বিএনপির কমিটি গঠনের পর থেকেই দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে নেতারা। সভাপতি এড. আবুল কালাম ও সাধারন সম্পাদক এটিএম কামালের নেতৃত্বে থাকে একটি পক্ষ এবং এড. সাখাওয়াত হোসেন খান আলাদা বলয় গড়ার লক্ষে পৃথক পৃথক কর্মসূচী পালন করেন। এছাড়া সাবেক এমপি গিয়াসউদ্দিনেরও রয়েছে আলাদা বলয়। তার উপর বর্তমান কমিটি বিলুপ্ত করা হবে এমন ঘোষণার কারণেও বিভক্তি আরো বাড়তে পারে বলেও মনে করছে তৃণমুলের নেতাকর্মীরা। তাছাড়া দীর্ঘদিন যাবৎ মহানগর বিএনপির কমিটির কার্যক্রম আটকে আছে মামলার গেড়াকলে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহলের মতে, প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে চলমান বিভেদের কারণে রাজনীতির সুতিকাগার এ নারায়ণগঞ্জের রাজনৈতিক অবস্থা অনেকটা সঙ্কটাপন্ন। এক কথায় বলতে গেলে, গেলো বেশ কয়েক বছরের রাজনৈতিক অবস্থা বিশ্লেষণ করে কোন্দল ও বিভক্তিই আওয়ামীলীগ-বিএনপির মূল অর্জন মনে করেন তারা।